Rose Good Luck নো-ম্যান্স ল্যান্ড (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৩) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১১ মার্চ, ২০১৫, ০৫:৫৭:৪৭ বিকাল

বাবা কি আলোকিত মানুষ ছিলেন?

রায়হান আজ পর্যন্ত জেনে এসেছে এই মানুষটি ওর 'বাবা'! শুধুই বাবা। আর বাবারা সব সময়েই সন্তানের কাছে আলোকিত মানুষ।

বাবা চেয়েছেন রায়হান বি.সি.এস পরীক্ষা দিয়ে ওনার মতো সরকারী কর্মকর্তা হোক।

তবে কি সরকারী কর্মকর্তারা সবাই এক একজন আলোকিত মানুষ?

হবে হয়তো।

বাবাদের চিন্তা-ভাবনা একেবারে সোজা-সাপ্টা হলেও তাতে সন্দেহ করা যায় না। প্রশ্ন তোলাও উচিত হবে না।

তাহলে প্রশ্ন একটি থেকেই যাচ্ছে। না হলে উচিত অনুচিতের প্রশ্ন আসছে কেন?

চিন্তা-ভাবনার এই পর্যায়ে রাসেল সাহেব এলেন। সিনিয়র শিক্ষক। গণিতের ক্লাশ নেন। রায়হানের প্রধান সেনাপতি বলা যায় তাঁকে। যদিও সহকারী প্রধান শিক্ষক একজন রয়েছেন। অন্য অনেক শিক্ষকের শিক্ষক তিনি। কিন্তু অবস্থা এখন হয়েছে এমন যে, বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের নিজেদের ভিতরের কোন্দলের কারণে শিক্ষক-প্রভাষকগণ ও দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন।

একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে আলোকিত মানুষ তৈরী করা হয়, সেখানেও যে এতো আঁধার থাকতে পারে, রায়হান কখনো ভাবেনি। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে অবশ্য নিজেদের শিক্ষকদেরকে দেখেছিল। কিন্তু নিজে সেই সময়ে এখনকার মত এতটা গভীরেও যেতে পারেনি এবং অনুভবের এতো তীব্রতাও তখন ছিল না।

রাসেল সাহেবের দিকে তাকালে তিনি বললেন-

‘ স্যার, আজ মুকুল সাহেব আসেন নি। ইলেভেন ক্লাশের ইংরেজি ক্লাশ। এখন...’

রাসেল সাহেব কি বলতে চাইছেন রায়হান বুঝতে পারে। বলে, ‘ আপনি যান। আমি আসছি।‘

গ্রামের কলেজগুলোতে এই এক সমস্যা। ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক পাওয়া খুব কষ্টকর। তার উপর কলেজ এম.পি.ও ভুক্ত নয়। আর প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে যে পরিমান সম্মানী দেয়া হয়, তাতে কি হয়? গ্রামে থেকে তো আর প্রাইভেট পড়িয়ে মাসে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা পাবে না। শহরে কিংবা মফঃস্বল শহরগুলোতে ইংরেজি বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যাচের পর ব্যাচ প্রাইভেট পড়ে থাকে।

রায়হান নিজেই নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ইংরেজির ক্লাশ নিয়ে থাকে। মুকুল সাহেব পার্ট টাইম প্রভাষক। তাও নিয়মিত আসেন না। সেজন্য রায়হানই এই বিষয়ের ক্লাশগুলো নেয়। জমির সাহেব রয়েছেন। ওর সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে। তাকেও রায়হান আসার পরে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রায়হানের ইচ্ছে ছিল ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি না হওয়াতে সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের একটি বিষয় নিয়ে পড়তে হয়েছে। অন্য বিভাগের বন্ধুরা বলতো ‘লিপস্টিক সাবজেক্ট’। তো এমন একটি লিপস্টিক সাবজেক্ট নিয়ে ভার্সিটির বছরগুলো রায়হান কাটিয়েছে ঠিকই। তবে সে পড়েছে এবং পরীক্ষা দিয়েছে ইংরেজীতে। রেফারেন্স বইগুলো যদিও অধিকাংশই ছিল ইংরেজীতে। আর এই বিষয়ের উপর ওর ভালোলাগাও গড়ে উঠেছিল।

লম্বা বারান্দা দিয়ে হেঁটে একেবারে শেষ মাথায় অবস্থিত কলেজ সেকশনের দিকে যেতে হয়। যাবার সময়ে নিচু ক্লাশের ভিতরের গুনগুন শব্দ সেই ক্লাশটিকে অতিক্রম করার সময়ে ওর জুতোর শব্দে এবং ওকে দেখে একদম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যদিও ক্লাশে শিক্ষক রয়েছেন। এই ছয়মাসে ছাত্র-ছাত্রীদের ভিতরেও এক আলাদা সমীহ জাগানো ভয় ঢুকে গেছে। ওদের নতুন প্রিন্সিপ্যালকে নিয়ে। সেটি কিভাবে হল, যথাসময়ে তা জানানো যাবে।

চলার পথে প্রচন্ড বাতাসের ঝাপটায় রায়হানের প্যান্টের নীচের অংশ পায়ের সাথে লেগে থাকে। এমন জোর বাতাস। মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। বাইরের দিকে তাকায়। ওর লাগানো সেগুন এবং অ্যাকাশিয়া গাছের চারাগুলো গোল বাঁশের খাঁচায় আবৃত হয়েও বাতাসের ধাক্কায় তালে তালে দুলছে। বুকের গভীর থেকে এক অন্যধরণের আনন্দে মনটা ভরে গেলো। প্রায় দেড়শো গাছের চারা সে আসার পরে লাগিয়েছে। স্কুল ভবনটি লাগোয়া অনেক প্রাচীন গাছ দেখতে পেয়েছে এখানে জয়েন করার পরে। ছাত্ররা ওকে জানিয়েছে, ‘অমুক হেডস্যার’ এই গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। সেগুলো আজ বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। সেদিনই রায়হান ভেবেছে, সে ও অনেক গাছ লাগাবে। একদিন ছাত্রদের মুখে ওর নামও উচ্চারিত হবে।

তবে কি তুমি নাম কামাতে চাও?

তুমি না আলোকিত মানুষ হবার প্রশিক্ষণ নিতে এসেছ?

নিজের মনের ভেতর থেকে নিজের কথা শুনে একটু বিরক্ত হয় রায়হান। মন ওকে আবারো বলে, ‘ সত্য কথা ভালো লাগবে না জানি। যাও ক্লাশ নাও গিয়ে।‘

কুচকানো ভ্রু জোর করে সমান করে। মনের ফুরফুরে ভাব যেটি নিজের সাথে কথা বলে এইমাত্র চলে গেছে, সেটিকে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। শেষে ব্যর্থ হয়ে ক্লাশে ঢুকে পড়ে।

ঘন্টা পড়ে গেলে নিজের রুমে আসে।

সাথে করে ভাবনাগুলোও বেহায়ার মতো চলে আসে। এদের হাত থেকে ওর মনে হয় নিস্তার নেই।

কিভাবে একজন ইংরেজীর প্রভাষক আনা যায়, ইদানিং এই বিষয়টি ই রায়হানকে ভাবিয়ে তুলছে। কেন একজন গ্রামের কলেজে চাকরি করতে চায় না? সেও তো এখানে করছে। ফান্ড থেকে ওকে দেয় দুই হাজার পাচশত টাকা মাত্র! আর নন-বি.এড স্কেলে ওর এম.পি.ও ভুক্তির কারণে আসে একই পরিমাণে। সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেক টাকা এই প্রতিষ্ঠানের প্রধানশিক্ষক কাম অধ্যক্ষ হিসেবে রায়হান প্রতিমাসে পেয়ে থেকে। তবে একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে অন্ধকার জগত থেকেও সে কিছু আয় করতে পারে। কিন্তু নিজে আলোকিত মানুষ হতে এসেছে বিধায় ঐ লাইনে তাকায়ও না সে। কিছুটা আভাষ অবশ্য রাসেল সাহেব ওকে দিয়েছিল। কিন্তু সে যেভাবে তাঁর দিকে তাকিয়েছিল এবং ওর চেহারায় ফুটে ওঠা ঘৃণা মেশানো অভিব্যক্তি দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল রাসেল সাহেব।

এত অল্প টাকায় কি হয়? কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানে এমনও শিক্ষক রয়েছেন, যাদের পুরো পরিবার চলে এর থেকেও কম টাকায়। এই ক’মাসে রায়হান এগুলো দেখেছে...নিজের ভেতরে অবর্ণনীয় কষ্টে বিদীর্ণ হয়েছে নিরন্তর। কিন্তু ওর কি করার আছে এ ব্যাপারে? সময় তখন এমনই। সিস্টেমের বেড়াজালে আবদ্ধ জীবন খুবই সংকীর্ণ গলিপথে চলতে বাধ্য হচ্ছিল।

প্রথমদিকে শহরের বাসা থেকেই রোজ যাওয়া-আসা করত রায়হান। ওর বাবা ওকে যাওয়া-আসার জন্য প্রতিদিন পাঁচশত টাকা দিতেন। মাস গেলে হিসাব করলে ওর বেতনের তিনগুণ টাকা বাবা ওকে দিতেন। এভাবেই সে বড় হয়েছে বাবার কাছে। শহুরে গতিময় জীবনে বড় হয়ে হঠাত করে সেখান থেকে এরকম অজ পাড়া গাঁতে থাকবে কখনো ভেবেছিল কি? কিন্তু চাকরিটা কেমন করে যেন হঠাৎ হয়ে যায়। একটা স্বপ্নের মতো ছিল ব্যাপারটি। এটিও পরে জানানো যাবে।

এই প্রতিষ্ঠান থেকে রায়হানের আয় হয়েছিল জয়েন করার দ্বিতীয় দিনে। তখন স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। শিক্ষক-প্রভাষকগণ এক একশ্রেণীর ইনভিজিলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। রায়হান নিজেও সেদিন স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব নিয়েছিল। পরীক্ষা শেষ হলে শহরের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার আগে হেড ক্লার্ক ওর রুমে আসে। এবং ত্রিশটি টাকা দিয়ে রেজিস্টারে ওর স্বাক্ষর নেয়। কিসের টাকা জানতে চাইলে সে বলেছিল ইনভিজিলেটর হিসেবে আজকের সম্মানী। একটু অবাক হয়েছিল। ভালোও লাগছিল। নিজের প্রথম হালাল আয়! যদিও চট্টগ্রাম থেকে এই প্রতিষ্ঠানে সে এসেছে ঢাকাগামী বাসের ডাইরেক্ট প্যাসেঞ্জার হিসেবে। তখন ভাড়া ছিল একশত পনের টাকা। সেই ১৯৯৮ ইং সালের কথা। আবার ফিরবার পথেও একইভাবে যাওয়া। তখন অবশ্য এতো টাকা লাগে না। কারণ ফিরতি পথে পথের মাঝ থেকে রায়হানকে উঠতে হয়।

এই প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম আর ঢাকার মধ্যবর্তী এক সীমান্ত এলাকায়।

সেদিন বাসায় ফিরে মায়ের হাতে জীবনের প্রথম উপার্জন তুলে দিয়েছিল রায়হান। মা কতটা খুশী হয়েছিলেন? তবে তাঁর ঝলমলে চেহারায় যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল সে দৃশ্য কি ভুলবার মতো? মা সেই টাকাগুলো খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। নিজের প্রথম সন্তানের প্রথম আয় বলে কথা! হোক না পরিমাণে সেটি খুবই কম।

চকতে নিজের মনে বেহায়া ভাবনাগুলো আর একটি চিন্তার উদ্রেক করায়।

আচ্ছা কণাও কি এই ত্রিশ টাকা পেলে খুশী হতো?

মা আর কণা থাকাবস্থায় সে কাকে টাকাটা দিতো?

মাকে দিলে কি কনা মেনে নিতো? কিংবা কণাকে দিলে মা?

উফফ! অসহ্য।

নিজের রিভলবিং চেয়ার থেকে উঠে পড়ে রুমের ভিতরে পায়চারি করে বেহায়া ভাবনাদের ততোধিক কুচক্রীসুলভ প্রশ্নগুলো থেকে নিস্তার পেতে চায় রায়হান। কিন্তু প্রশ্নগুলোও ওর পিছু পিছু সাথে সাথে থাকে।

এতো সহজে কি মুক্তি পাওয়া যায়?

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

১৩৮৩ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

308375
১১ মার্চ ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৪৭
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামুলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহ!

গাছ লাগানো আমারো খুবি প্রিয় একটি কাজ!আমাদর বাড়িতে অনেক গাছ লাগিয়েছি! অনেক বড় এখন সেগুলো!

প্রথম উপার্জন মায়ের হাতে দেয়ার তৃপ্তি অসাধরন! চমৎকার লাগলো লিখাটি! অনেক শুকরিয়া ও শুভকামনা রইলো Good Luck Praying
১২ মার্চ ২০১৫ সকাল ০৯:২০
249511
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ!
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা জানবেন।Good Luck Praying
308431
১২ মার্চ ২০১৫ রাত ০১:২১
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু শ্রদ্ধেয় সুহৃদ ভাইয়া। অনবদ্য সুন্দর লিখাটির জন্য ভালোলাগা অনুভূতিসহ অনেক অনেক দোয়া প্রার্থনা রইলো আপনার জন্য। জাজাকাল্লাহু খাইর।
১২ মার্চ ২০১৫ সকাল ০৯:২২
249512
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ!অনেক ধন্যবাদ প্রিয় আপুজি। আপনার ভালোলাগা অনুভূতি জেনে ভালো লাগল। আপনার জন্যও দোয়া রইলো।
বারাকাল্লাহু ফীহ।Good Luck Praying
309310
১৬ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৫:১৩
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আসসালামুলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহ!
মামুন ভাইয়া আগের ধারাবাহিক লেখাটা তো শেষ করলেন না!
(পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ) এটার অপেক্ষাতে আছি কবে আবারও পোস্ট করবেন? অনুরোধ তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ! ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেন না!
ধন্যবাদ ভাইয়াকে
১৭ মার্চ ২০১৫ সকাল ০৮:১৮
250385
মামুন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ৩৪ পর্ব পর্যন্ত গিয়ে আটকে গেছি। অনেক পরালেখা করতে হচ্ছে। ইনশা আল্লাহ দ্রুত ই শেষ করতে পারবো।
ভালো থাকুন আপনি।
শুভ সকাল।Good Luck Good Luck
১৭ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৪:৫৯
250461
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : যখনই সময় পাই ব্লগে একটু সময়ের জন্য হলেও ঢুঁ মারি! আর তখনই খুজতে থাকি প্রিয় প্রিয় লেখখের প্রিয় প্রিয় লেখাগুলো! যখন খুজে পাই মনটা আনন্দেতে ভরে ওঠে আর না পেলে মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে! তাই অনুরোধ রেখে গেছি সেদিন মন্তব্যে
২২ মার্চ ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৪০
251478
মামুন লিখেছেন : আর অল্প কয়েকদিন অপেক্ষা করুন। লিখাটি শেষ করার জন্য আমি অনেক কষ্ট করছি। এটাই হবে আমার ১ম বই আকারে ছাপানো উপন্যাস।

শুভেচ্ছা জানবেন।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File